বদিউজ্জামান কে?

 

বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসীর (রহঃ) সংক্ষিপ্ত জীবনী

 

আল্লামা নুরসির যুবক কালে একবার মিসরের আযহার ইউনিভার্সিটির রেক্টর বা উচ্চ-পদস্থ বড় এক আল্লামা শেখ বাহিদ রহঃ তুর্কিতে আসলে ও তার বন্দু বান্দবের খাতিরে নুরসির সাথে এক মুনাযারায় বসেছিলেন এবং চা খাওয়ার ফাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে উসমানী খেলাফতের হুকুমত ও ইউরোপের হুকুমত সম্পর্কে কি মনে কর? এই দুই রাষ্ট্রের ব্যাপারে তুমার মতামত কি? মুলতঃ শেখ বাহিদ প্রশ্নটি নুরসির জ্ঞানের পরিক্ষার জন্যে নহে বরং ভবিষ্যতের দুনিয়ার রাজনীতির গতি সম্পর্কে তার জানার উদ্দেশ্যে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন। নুরসিও উত্তরে বলেছিলেন যে,

اِنَّ الْاَوْرُوبَا حَامِلَةٌ بِالْاِسْلَامِيَّةِ فَسَتَلِدُ يَومًا مَا وَ اِنَّ الْعُثْمَانِيَّةَ حَامِلَةٌ بِالْاَوْرُوبَائِيَّةِ فَسَتَلِدُ اَيْضًا يَوْمًا مَا

অর্থাৎ- ইউরোপ একটি ইসলামের রাষ্ট্রে ও উসমানী রাষ্ট্র একটি ইউরোপের রাষ্ট্রে গর্ভপাত হয়ে আছে। সময় আসলে একদিন বাস্তবতা প্রকাশ্যে চলে আসবে, তথা এই গর্ভপাতের বাচ্ছা জন্ম গ্রহণ করবে। এই উত্তর শুনে হযরত শেখ বাহিদ রহঃ বলেছিলেন যে, এই যুবকের সাথে মুনাযারা করা অসম্ভব, তার সাথে মুনাযারা করা উচিৎ নহে, আমিও তার উত্তরের সাথে একমত ছিলাম। এই প্রশ্নের উত্তর কেবল মাত্র এই পন্থায় সহজ ও সাবলীল এবং অলংকারের মুক্তাযায়ে হাল অনুযায়ী উত্তর দেওয়া এই ভাবে শুধুই বদিউজ্জামানের জন্যে বিশেষ ক্ষমতার ব্যাপার। তিনি এই কথাগুলো সাঈদ নুরসী সম্পর্কে বলেছিলেন। আল্লামা নুরসির একটি তাত্ত্বিক পরামর্শ হল এই যে, পথপ্রদর্শক কোন কিতাব নির্বাচনের ক্ষেত্রে অত্যান্ত সচেতন থাকতে হবে। কারণ এই জামানাটার, থর থর করে রুপ আকৃতির ভিন্নমুখী ডিজাইনে ধোঁকাবাজি এতই বেশী যে, পর্দার ঠিক বিপরীত দিকে ইসলামের যুবকদেরকে তারা ধ্বংস, নষ্ট, অপদস্থ, লাঞ্চিত করে তাদের দিকে নিয়ে ব্যাস্থ রেখে দিতে অতি কৌশলে কাজ করে যাচ্ছে। সুতরাং কোন বইকে পড়ার আগে বা কোন কথাকে শুনার কালে প্রথমেই এই কথাগুলোর উত্তর খুজে নিবে আর তা হল;

مَنْ قَالَ وَ لِمَنْ قَالَ وَ لِمَا قَالَ وَ ف۪يمَا قَالَ

অর্থাৎ কে বলেছে? কাকে বলেছে? কেন বলেছে? কোন লেভেলে বলেছে? এই ভিত্তি মুলক নীতির উত্তর খুজে বিবেচনার দৃষ্টিতে আনা জরুরী। আর এটাই হচ্ছে কোন কথার লেভেলের উচ্ছতা, সুন্দর্যতা, ক্ষমতার প্রারম্ভিকা কে আত্মস্থ করার দিক সমূহ। ভুলে গেলে চলবেনা কথার চারটি শর্ত হল বক্তা, শ্রোতা, কথা, লেভেলের স্বার্থকথা।

তিনি মহাবিশ্বের প্রকৃত রূপকে মহান স্রষ্টার নিদর্শন হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি অকাট্য যুক্তির মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, উপরোক্ত ব্যাখ্যার আলোকে এই আয়াত সমূহ যদি পাঠ করা হয় তাহলে ঈমানের মৌলিক বিষয় সমূহের হাক্বীক্বাত সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। এ পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে কোন ব্যক্তি এমন প্রকৃত ও মজবুত ঈমানের স্তরে পৌছতে সক্ষম হয় যা প্রকৃতিবাদ, জড়বাদ ও নাস্তিক্যবাদের সূক্ষ্ম বেড়াজাল থেকে উদ্ভূত সংশয় সমূহের মোকাবেলা করতে সক্ষম। সকল বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উন্নতির অর্থ হচ্ছে নিখিল বিশ্বের দ্বার উন্মোচন করা। এই বিশ্বজগতকে যদি এক বিশাল গ্রন্থরূপে দেখা হয় যার প্রতিটি অক্ষর “গ্রন্থ প্রণেতা”র প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে তাহলে তা ঈমানের বুনিয়াদকে শুধু মজবুতই করে না, তাকে গভীর ও সম্প্রসারিতও করে। মানুষের মৌলিক চাহিদা হচ্ছে এমন এক দ্বীন যার মাধ্যমে সে মহান স্রষ্টা আল্লাহকে তাঁর সকল সুন্দরতম নাম ও গুণাবলীসহ চিনতে সক্ষম হয়। রিসালে-ই নুর মানুষের কাছে তার স্রষ্টার পরিচিতি সহজ ও সাবলীলভাবে উপস্থাপন করে; এটা মুসলমানদেরকে অনুকরণীয় ঈমান থেকে প্রকৃত (তাহক্বীকি) ঈমানের দিকে ধাবিত করে; অমুসলিমদেরকে সৃষ্টির উপাসনা থেকে স্রষ্টার ইবাদতের দিকে আহ্বান করে । মহা প্রজ্ঞাময় কুরআনের পথ দেখায়।

বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী (রহঃ) ১৮৭৬ সালে পূর্ব তুরস্কের বিতলিস প্রদেশের নুরস নামক গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি অতি উচ্চস্থরের আলিম ছিলেন যিনি প্রথাগত দ্বীনি বিষয় ছাড়াও আধুনিক বিজ্ঞানে শিক্ষিত ছিলেন । যৌবনেই তিনি শিক্ষা দীক্ষায় অসাধারণ বুৎপত্তি লাভ করেন এবং বদিউজ্জামান (কালের বিস্ময়) খেতাব অর্জন করেন। বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসীর (রহঃ) জীবনকাল উসমানী খিলাফত, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের পতন ও বিভাজন, ১৯২৩ সালে তুরস্ক প্রজাতন্ত্র গঠন এবং এর পরের ৩৭ বছর পর্যন্ত ব্যপ্ত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী কয়েক বছর পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯২৩ সাল পর্যন্ত বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী (রহঃ) মানবতার জন্য ইসলামের পথে সংগ্রাম করেন । তিনি অগনিত ছাত্রকে শিক্ষাদান এবং সমকালিন প্রথম সারির আলেমদের সংগে বিভিন্ন দ্বীনি কর্মকান্ডে জড়িত থাকা ছাড়াও পূর্ব তুরস্কে রুশ সৈন্যদের আক্রমন প্রতিরুধে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতৃত্ব দান করেন। রুশদের বিরুদ্ধে দুই বছর যুদ্ধে সক্রিয় থাকার পর যুদ্ধাহত অবস্থায় তিনি বন্দী হন। বন্দীত্ব থেকে অলৌকিকভাবে মুক্তিলাভের পর ইসলামের স্বার্থ সমুন্নত করার জন্য জনজীবনে বিভিন্ন কর্মকান্ডে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। যাইহোক, যে বছরগুলতে ওসমানী খিলাফত ভেঙ্গে তা প্রজাতন্ত্রে রূপ লাভ করে সেই বছরগুলোতেই তিনি “পুরাতন সাঈদ” থেকে “নতুন সাঈদ”- এ রূপান্তরিত হন। “নতুন সাঈদ”-এ রূপান্তর ছিল তাঁর জন্য জনজীবন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে পড়াশুনা ও ইবাদত-বন্দেগীতে মগ্ন থাকা, যা তখন ছিল এক নতুন ধরনের সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি। দুই বছর পরে অর্থাৎ ১৯২৫ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকারের ধর্মনিরপেক্ষ কর্মকান্ড ও দমন নীতির বিরোধিতা করায় তাঁকে পশ্চিম আনাতোলিয়ায় নির্বাসিত করা হয় এবং এর পরের সাতাশটি বছর তাঁর জীবন শাসক গোষ্ঠীর অত্যাচার, হয়রানি এবং কারাদন্ড ভোগের মাধ্যমে অতিবাহিত হয়। কিন্তু কারাদন্ড ও নির্বাসনের এই বছরগুলিতেই প্রায় ছয় হাজার পৃষ্ঠার “রিসালে-ই নূর গ্রন্থসমগ্র” লিখিত হয় এবং সমগ্র তুরস্কে তা ছড়িয়ে পড়ে। সাঈদ নুরসী নিজেই বলেন, এখন আমি স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি যে, আমার জীবনের অধিকাংশ সময়ই নিজ ক্ষমতা, দূরদর্শিতা, উপলব্ধি এবং ইচ্ছার বাইরে এমনভাবে পরিচালিত হয়েছে যাতে কোরআনের খেদমতের জন্যই এই বইগুলো লিখিত হয় । জ্ঞান চর্চায় ব্যয়িত আমার সমগ্র জীবন যেন ছিল “রিসালে-ই নুর” লেখার প্রাথমিক প্রস্তুতি মাত্র। ইসলামী দুনিয়ার অধঃপতনের মূল কারণ যে ঈমানের ভিত্তি দূর্বল হয়ে যাওয়া একথা বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী (রহঃ) বুঝতে পেরেছিলেন। এই দূর্বলতার সাথে বস্তুবাদ ও নাস্তিক্যবাদ এবং অন্য সকল অপশক্তির আক্রমন এক হয়ে উনবিংশ এবং বিংশ শতকে ঈমানের ভিত্তিকে দূর্বল করে দেয়। ফলে তাঁর এই বদ্ধমূল ধারণা হয় যে, ঈমানকে মজবুত করা এমনকি বাঁচিয়ে রাখাই বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জরুরী এবং প্রধান কাজ। সে সময় যা প্রয়োজন ছিল তা হচ্ছে ইসলামের ইমারতকে তার ভিত্তিতে পূণঃনির্মাণ করার নিমিত্তে সব ধরনের প্রচেষ্টা করা এবং কলমের জিহাদের মাধ্যমে সকল আক্রমণকে প্রতিহত করা।

বস্তুতঃ “রিসালে-ই নূর”-এ তিনি এ কথাই প্রমান করেন যে, বিশ্বজগতের কর্মকান্ড বিষয়ক বিজ্ঞানের শ্বাসরুদ্ধকর আবিস্কার দ্বীনের হাক্বীকাতকেই বরং মজবুত করে । রিসালে-ই নূরের গুরুত্ব অতিরঞ্জিত করার কোন অবকাশ নেই কারণ বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী (রহঃ) নিজেই তুরস্কের ইতিহাসের অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে ইসলামী আকীদা ও ঈমানকে পুনর্জীবিত করেন; এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর এই ভূমিকার গুরুত্ব বর্তমান সময় পর্যন্ত ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও “রিসালে-ই নূর” শুধুমাত্র যে মুসলমানদের সমস্যার সমাধান দেয় তাই নয় বরং সমস্ত মানবকূলের জন্যেও তা বেশ কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমতঃ “রিসালে-ই নূর” লেখা হয়েছে আধুনিক মানুষের মানসিকতাকে লক্ষ্য রেখে, যে মানসিকতা মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে জড়বাদী দর্শনে আচ্ছন্ন কোন ব্যক্তির মনে যেসব বিভ্রান্তি, সন্দেহ ও প্রশ্নের জন্ম দেয়, রিসালে-ই নূর তার সঠিক উত্তর দিতে সক্ষম। এটা আধুনিক মানুষের সকল “কি, কেন, কিভাবে”-র উত্তরও দিয়ে দেয়। রিসালে-ই নূর ঈমানের অতি গভীর বিষয়বস্তুসমূহ সাধারন মানুষের জন্য এমন সহজ সরলভাবে ব্যাখ্যা করে যে, নবীনরাও তা বুঝতে পারে এবং ফায়দা লাভ করতে পারে। অথচ ইতিপূর্বে ঈমানের এ সমস্ত সূক্ষ্ম ও সুগভীর বিষয়ে শুধুমাত্র বিজ্ঞ আলেমগণই পড়াশুনা করতেন। বিশ্বজগৎ এবং মানুষের প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি রিসালে-ই নূরে এ কথা প্রমাণ করেন যে, প্রকৃত সুখ ঈমান এবং আল্লাহর পরিচয় লাভের মাঝেই নিহিত রয়েছে। তিনি এও দেখিয়ে দেন যে অশান্তি ও যন্ত্রণা যা কুফরের মাধ্যমে জন্ম নিয়ে মানুষের রূহ আচ্ছন্ন করে তা শুধুমাত্র প্রকৃত ঈমানের দ্বারাই নিবৃত করা সম্ভব। পবিত্র কুরআন মানুষের বিবেক-বুদ্ধিকে সম্বোধন করে। এই প্রজ্ঞাময় কিতাব মহাবিশ্ব এবং এর সত্যতা সঞ্চরণশীলতা ও পরিবর্তনশীলতার প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে যাতে সে মাখলুক হিসেবে তার নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনুধাবন করতে পারে । রিসালে-ই নূরে সাঈদ নুরসী শিক্ষাদানের এই পদ্ধতিই অনুসরণ করেছেন। এবং অনেক সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের পথ মাড়িয়ে ৮৪ বছর বয়সে ১৯৬০ সালে উরফায় ইন্তেকাল করেন। (অংশ বিশেষ সংগৃহীত, অনু;)